দ্যা লস্ট সিটি অফ জেড নামটি প্রথম এসেছিল লেঃ কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাওকেটের মুখ থেকে, যিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ সার্ভেয়ার, প্রত্নতত্তবিদ এবং দক্ষিন আমেরিকান অভিযাত্রী। ফাওকেটের ধারনা অনুযায়ী, আমাজনের গহীন জঙ্গলে, ব্রাজিলের ম্যাটো গ্রসো অঞ্চলে হারানো এই শহরের অবস্থান ছিল।
১৯০০ সালের প্রথম দিকেই ফাওকেট এই শহরটি সম্পর্কে শুনেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকেই তিনি এই শহরের অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে হারানো এই শহরের অনুসন্ধান অভিযানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর্নেল ফাওকেট, তাঁর ছেলে জ্যাক এবং জ্যাকের বন্ধু রিমেক আমাজনের গহীন জঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে যান।
ম্যানুস্ক্রিপ্ট-৫১২ নামে একটি প্রাচীন পুস্তিকায় রহস্যময় এই শহরের কথা প্রথম পাওয়া যায়। পর্তুগীজ দাস ব্যাবসায়ী সিলভা উল্লেখ করেছিলেন, ১৭৫৩ সালে সে এই শহরে গিয়েছিল। শহরটির বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করলেও, এর সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে কোনও তথ্য সে দেয়নি। ম্যানুস্ক্রিপ্ট-৫১২ তে পাওয়া যায় যে, ১৬০০ সালের প্রথম দিকে স্থানীয়দের কাছে মুরিবেকা নামে পরিচিত এক জন আধা পর্তুগীজ, আধা ভারতীয় আদিবাসী আমাজনের গহীন জঙ্গলে স্বর্ণ, রুপা এবং মূল্যবান পাথরের এক খনি আবিষ্কার করে। ১৬২২ সালে তার মৃত্যুর সাথে সাথে এই স্বর্ণখনির রহস্যও হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৭৪৩ সালে পর্তুগিজদের আমাজন অভিযানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাথরের গায়ে আঁকা অদ্ভুত কিছু হায়ারোগ্লাফিক্স তাঁরা আবিষ্কার করে, যা আসলে অতি পুরাতন কোনও সভ্যতার অস্তিত্তের নির্দেশ করে।
ফাওকেট আন্দাজ করেন, এই হারানো শহরের বয়স কমপক্ষে এগারো হাজার বছর এবং সেখানে রয়েছে অনেক স্বর্ণের মজুত। সম্ভবত পর্তুগীজ অভিযাত্রীদের শতাব্দী ধরে খুঁজে আসা “হারানো সাত” শহরের একটি হচ্ছে এটি, পৌরাণিক রুপকথায় যার অপর নাম এল-ডোর্যাডো।
ফাওকেটের মতে জেড ছিল প্রাচীন নগরী আটলান্টিসের রাজধানী।
যদিও পুরাতত্ত খননের কোনও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা তাঁর ছিলনা, কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ঐতিহাসিক সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কারের আশায় তাঁর পথ চেয়ে আছে। আমাজনের বিশালত্ত্ব এবং তার বেশীরভাগ অনাবিষ্কৃত অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবেই জ্ঞান রাখতেন তিনি।
পার্সি হ্যারিসন ফাওকেটের জন্ম ১৮৬৭ সালের ১৮ আগস্ট, ইংল্যান্ডের ডেভনে। তাঁর বাবা ছিলেন রয়্যাল জিওগ্র্যাফিকাল সোসাইটির একজন সদস্য। ১৯০১ সালে তিনি নিজেও রয়্যাল জিওগ্র্যাফিকাল সোসাইটিতে যোগদান করেন সার্ভেয়িং এবং ম্যাপমেকিং নিয়ে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে। এই সময় তাঁর সাথে বন্ধুত্ত হয় বিখ্যাত লেখক স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এবং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সাথে। পরবর্তীতে ফাওকেটের আমাজনের এক্সপিডিসন রিপোর্ট গুলো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে আর্থার কোনান ডয়েলের জগদ্বিখ্যাত “দ্যা লস্ট ওয়ার্ল্ড” বইয়ে।
দক্ষিন আমেরিকাতে ফাওকেটের প্রথম অভিযান ছিল ১৯০৬ সালে। এই সময় তিনি রয়্যাল জিওগ্র্যাফিকাল সোসাইটির অর্থায়নে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সীমানার জঙ্গল এলাকার মানচিত্র তৈরি করেন। ১৯০৭ সালে তিনি বলিভিয়ার লাপাজ অঞ্চলে আসেন। এখানে তিনি একটি ৬২ ফুট অ্যানাকোন্ডা গুলি করে মারেন। এছাড়াও তিনি অনেক প্রাণীর বর্ণনা দেন, প্রাণীবিজ্ঞানের ইতিহাসে যা ছিল অজ্ঞাত।
১৯০৬-১৯২৪ সালের মধ্যে ফাওকেট সাতটি এক্সপিডিসন পরিচালনা করেন। আদিবাসীদের সাথে তিনি ধৈর্য, বিনয় এবং বিভিন্ন উপহার প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯১০ সালে তিনি ব্রাজিলের রিও ভার্দে নদীর উৎস অনুসন্ধান করেন। পেরু এবং বলিভিয়ার সীমান্তবর্তী হিথ নদীতে এই সময়ে তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। ব্রাজিলে থাকাকালীন একটি গবেষণার কাজের সময় তিনি হারানো এই শহরের ধারনা পান এবং নামকরন করেন জেড। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান।
১৯২৫ সালে ফাওকেট পুনরায় ব্রাজিলে ফিরে আসেন তাঁর বড় ছেলে জ্যাক এবং জ্যাকের এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে। পৌরাণিক কাহিনী এবং পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে তিনি নিশ্চিত ছিলেন ব্রাজিলের ম্যাটো গ্রসো অঞ্চলের জঙ্গলের কোথাও প্রাচীন একটি শহরের অস্তিত্ত রয়েছে যার নামকরণ তিনি করেন জেড হিসেবে। অভিযানে বের হওয়ার আগে ফাওকেট নির্দেশ দিয়ে যান, তাঁরা যদি ফিরে না আসেন তাহলে যেন কোন উদ্ধারকারী দল পাঠানো না হয়, কারন তাদেরকেও একই ভাগ্য বহন করতে হবে। এতোটাই দুর্গম এবং বিপদজনক ছিল সেই অঞ্চল।
সেক্সট্যান্ট, ক্রনোমিটার, টিনজাত খাবার ইত্যাদি নিয়ে ভ্রমন করার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছিল ফাওকেটের। হালকা মালসামান এবং স্থানীয় আদিবাসীদের চোখ এড়ানোর জন্য তাঁরা মাত্র তিনজন মানুষই রওনা দেন অজানার উদ্দেশ্যে। এইসব আদিবাসীদের কিছু রয়েছে বর্বর যারা তখনও পর্যন্ত সভ্যতার মুখ দেখেনি। হয়তো অভিযানের গুরুত্ত এবং ভয়াবহতা ফাওকেট সম্পূর্ণ অবমূল্যায়ন করেছিলেন। যেসব অঞ্চল তিনি সার্ভেইংয়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, সেইসব স্থানে যাওয়া, এমনকি যাওয়ার চেষ্টা করাটাও ছিল অনেক ভয়াবহ। স্থানীয় আদিবাসীরা, বাইরের পৃথিবীর সাথে যাদের যোগাযোগ শুধুমাত্র রাবার বাগানের জন্য দাস ব্যাবসায়িদের কৃতদাস খোঁজার মাধ্যমে, সাদাদের প্রতি ছিল তাঁদের অপরিসীম ঘৃণা। তারপরও, পরাজয় মেনে নেয়ার মতো লোক ফাওকেট ছিলেন না।
১৯২৫ সালের এপ্রিলের ২০ তারিখ ব্রাজিলের কুইয়াবা থেকে তাঁদের অভিযান শুরু হয়। এই সময় তাঁদের সাথে ছিল দুইজন ব্রাজিলিয়ান শ্রমিক, দুইটি ঘোড়া, আটটি খচ্চর এবং এক জোড়া কুকুর। ১৯২৫ সালের ২৯ জুলাই তাঁদের সর্বশেষ খবর পাওয়া যায়, যখন ফাওকেট তাঁর স্ত্রীকে ডেড হর্স ক্যাম্প থেকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে বলা হয় জঙ্গলের অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে তাঁরা এখন যেতে প্রস্তুত। আমাজন নদীর দক্ষিণপূর্ব উপকূলীয় উপনদী জিংগু অতিক্রম করার কথা ছিল তাঁদের। চিঠিতে তিনি তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে উল্লেখ করেন এবং অভিযানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন। একজন স্থানীয় রানার চিঠিটা বহন করে নিয়ে আসে।
তাঁর ঘোড়ার মৃত্যুর কারনে তিনি এই ক্যাম্পের নাম দেন, ডেড হর্স ক্যাম্প। এই চিঠির পর তাঁদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অনেকের ধারনা স্থানীয় আদিবাসীরা তাঁদের খুন করেছে, যদিও সঠিক কোনও প্রমান এর স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি। কালাপালোস আদিবাসীরা সর্বশেষ তাঁদের দেখেছিল। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী জ্যাক এবং রিমেক ছিল সেই সময়ে পঙ্গু এবং অসুস্থ।
আবার অনেকের মতে আমাজনের প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতিকুলতা এবং হিংস্র জন্তুর আক্রমনেও তাঁদের মৃত্যু হতে পারে। অনেকে আবার মনে করেন, ফাওলেট তাঁর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে স্থানীয় এক উপজাতি গোত্রের প্রধান হিসেবে বাকি জীবন পার করেছেন।
অনেক অভিযাত্রীরাই এরপর অনুসন্ধান করেছেন ফাওকেটের ভাগ্য জানার জন্য, কিন্তু সবই ছিল বৃথা। অনেক রকম গুজব শোনা গেছে পরবর্তীতে, কিন্তু সেগুলো যাচাই করার কোনও পথ ছিলনা। ফাওলেটের ভাগ্য জানার জন্য প্রায় ১৩টি এক্সপিডিসনে প্রায় ১০০ জন অভিযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
১৯২৭ সালে ফাওকেটের একটি নেম-প্লেট পাওয়া যায় স্থানীয় এক ইন্ডিয়ান উপজাতির কাছে। নেম-প্লেটটি ছিল ওই আদিবাসীদের প্রধানকে দেয়া ফাওলেটের উপহার। পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালের জুন মাসে কর্নেল বোটেলহো ম্যাটো গ্রসোর কাছাকাছি ফাওকেটের ব্যবহৃত একটি কম্পাস উদ্ধার করেন। জঙ্গলে প্রবেশ করার আগে তিনি কম্পাসটি ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।
ফাওকেটের রোমাঞ্চকর এবং রহস্যময় অভিযান এবং তাঁর এই নিরুদ্দেশ হওয়া ইতিহাসের পাতায় আজও এক অমীমাংসিত রহস্য। ১৯২৫ সালের সেই অভিযানে ফাওকেট নিশ্চিত ছিলেন যে আমাজনের গভীরে হারানো এক শহর খুঁজে পেয়েছেন তিনি, পরবর্তীতে অনেকে যেটাকে এল-ডোর্যাডো নামে আখ্যায়িত করে।
তথ্যসুত্রঃ
লেঃ কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাওকেট