পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন রেইন ফরেস্ট হল মালেয়শিয়ার তামান নেগারা রেইনফরেস্ট যেটার বয়স ১৩০ মিলিয়ন বছর। তামান নেগারা হল মালেয়শিয়ান শব্দ যার ইংরেজি অর্থ ন্যাশনাল পার্ক। কিন্তু মালেশিয়ায় ৩০ টারও বেশি ন্যাশনাল পার্ক আছে। তাই এক্ষেত্রে ট্রান্সলেট করে কনফিউজড হওয়ার কারন নেই, কেননা এটি তামান নেগারা রেইনফরেস্ট নামেই পরিচিতি।
কিভাবে যাবেনঃ
আপনার পছন্দ ও সুবিধা মতন অনেকভাবেই তামান নেগারা যেতে পারেন। তামান নেগারা যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। তবে সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হবে। কেননা কুয়ালালামপুর থেকে কুয়ালাতাহান গ্রামে পৌঁছাতে সময় লাগে মোট ৭-৮ ঘণ্টার মতন। আর জিরানতুত থেকে বাসে কিংবা বোটে যেতে চাইলে দুপুর ১ টার পরে লোকাল বাস কিংবা বোট কিছুই আর ছাড়েনা। তাই জার্নি টা আগে ভাগে সকাল সকাল শুরু করতে পারলেই ভালো। অনেকে আবার কুয়ালালামপুর থেকে সরাসরি কুয়ালাতাহান পর্যন্ত শেয়ার টেক্সিতে করে যায়। আপনি চাইলে সেটাও করতে পারেন। আমি বাসে করেই যাবো। কারন নতুন কোন দেশ কিংবা এলাকায় ট্যাক্সির চেয়ে বাসে চড়তেই বেশি পছন্দ করি আমি। এতে করে লোকাল মানুষের লাইফস্টাইল, কালচার ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক ধারনা পাওয়া যায়।
কুয়ালালামপুর বাস টার্মিনাল থেকে এক্সপ্রেস বাসে করে যেতে হয় জিরানতুত বাস টার্মিনাল। বাস ভাড়া ১৮-২১ রিঙ্গিত। ২০০ কিমি এই জার্নিতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টার মতন। ট্রেনে যেতে চাইলে ও একইভাবে জিরানতুত পর্যন্ত ট্রেনে যাওয়া যায়। জিরানতুত থেকে কুয়ালা তাহান গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৬৮ কিমি- যেতে পারেন বাস, প্রাইভেট কার কিংবা বোটে করে। লোকাল বাস ভাড়া ৭ রিঙ্গিত। বাসে করে যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টার মতন। ট্যাক্সি রিজার্ভ করে নিয়ে যাওয়া যায় ভাড়া ৫০ রিঙ্গিত মতন। বাসে যেতে ১.৩০ ঘণ্টা আর ট্যাক্সিতে গেলে ১ ঘণ্টার মতন সময় লাগে। আপনি যদি ৩ ঘণ্টা বোটে করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে চান তবে বোটে করে যাতে পারেন বোট ভাড়া প্রতিজন ৪০ রিঙ্গিত। বোট ছাড়ে কুয়ালা তেম্বলিং থেকে। আগেই বলেছিলাম দুপুর ১ টার পরে আর কোন নৌকা ছাড়ে না। তাই বোটে বা পাবলিক বাসে যাওয়ার প্ল্যান থাকলে দুপুর ১ টার মধ্যে জিরানতুত থাকতে হবে অবশ্যই। আমার কাছে ফেরার সময় বোটে করে ফেরাটাই বেশি সুবিধাজনক মনে হয়েছে।
আমি কুয়ালালামপুর থেকে ১ টার বাসে উঠেছি। জিরানতুত এসে পৌঁছেছি বিকেল ৪ টার দিকে। ফলে জিরানতুত এসে পাবলিক বাস আর ধরতে পারিনি। প্রাইভেট কার রিজার্ভ করে রওয়ানা দিলাম কুয়ালা তাহানের উদ্দেশে। মসৃণ সমান্তরাল রাস্তা যেন নীল আকাশের সাথে মিশেছে আর দুই পাশের ঘন সবুজ গাছ, পামের বাগান, বিকেলের গোধূলি আলো সব মিলিয়ে অপার্থিব এক দৃশ্য দেখতে দেখতে পোউছালাম কুয়ালা তাহান গ্রামে। তামান নেগারা রেইনফরেস্টের পাশেই ছোট্ট একটি গ্রাম যেটার নামই হচ্ছে কুয়ালা তাহান। ছোট বড় হোটেল, মোটেল, হোস্টেল সবকিছুই আছে এখানে তাই এই গ্রামেই বেশীরভাগ টুরিস্টরা থাকে।
আমি যখন পউছালাম কুয়ালা তাহান তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আগে থেকে হোটেল বুক করা ছিলনা। কোন উৎসব কিংবা বিশেষ কোন কারন না ঘটলে এখানে এসেই হোটেল পাওয়া যায়, আগে থেকে বুক করে রাখতে হয়না। কিন্তু তামান নেগারা রেইনফরেস্টের ভেতরে ৫স্টার মানের একটি রিসোর্ট আছে। আপনি যদি সেখানে থাকতে চান তাহলে আগে থেকে বুক করে আসাই ভালো।
আমি গাড়ী থেকে নেমে হোটেল খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষন খোঁজার পরেই আমার বাজেট এবং পছন্দ অনুযায়ী হোটেল পেয়ে গেলাম। এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে- কুয়ালা তাহানের হোটেলগুলোর রিসিপশন সন্ধ্যা ৬টার পরে বন্ধ হয়ে যায়। তাই এর আগেই হোটেল বুক করতে হবে। হোটেল ঠিক করে রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। ছোট্ট একটা নদী যার এক পাড়ে ছোট্ট কুয়ালা তাহান গ্রাম। আর অন্য পাশেই তামান নেগারার ঘন জঙ্গল। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজ রাতে আর কিছু করার নেই। একটু আগে আগেই ঘুমিয়ে পরবো। কেননা কাল সকালে উঠতে হবে এবং জঙ্গলে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে। তাই একটু বেশি রেস্ট দরকার।
আপনিও রেডি থাকুন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন রেইনফরেস্ট এবং সবচেয়ে লম্বা কেনোপি ওয়াকের অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য। শুভ রাত্রি !!!
**************
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ৬.৩০ টায়। উঠেই নাস্তা সেরে নিলাম নদিতে ভাসমান রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকেই বোটে উঠলাম। এদের একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে- একজন লোক ও দাঁড়িয়ে থাকলে ঐ পাড় থেকে বোট চলে আসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়না। যেহেতু আজকে সারাদিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে তাই পিঠে ছোট্ট একটি ব্যাকপ্যাক নিলাম যেটাতে আছে ১ বোতল পানি, ২-১ টা চকোলেট আর, চিপস। বোট আসতেই উঠে পরলাম বোটে। বোট ম্যানের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতেই নেমে গেলাম বোট থেকে।
এমনিতেই জঙ্গল আমার খুব ভালো লাগে। আর আজকে যাচ্ছি ১৩০ মিলিয়ন বছর ধরে বেঁচে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন জঙ্গলে। পৃথিবীর কত ইতিহাসের, কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এই জঙ্গল। তামান নেগারা রেইনফরেস্টের মোট আয়তন ৪৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার। এর বিশাল ঘন সবুজ জঙ্গল, স্রোতস্বিনী নদীর রুপ আর ঐতিহাসিক প্রাচুর্যময়তার কারনে প্রতি বছর ১,০০,০০০ এর ও বেশি টুরিস্ট আসে এখানে।
বোট থেকে নামতেই একটি ইকো রিসোর্ট যেটির নাম- সেরি মুতিয়ারা। রিসোর্ট টা এক্কেবারে নদীর পাড় ঘেঁসে যা আরও বেশী নান্দনিক করে তুলেছে রিসোর্ট টি কে। আপনি চাইলে এখানেও সকালের নাস্তা টা করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তার আগে পকেট টা ভালো করে চেক করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কেননা এটি একটি পাঁচতারা মানের রিসোর্ট।
জঙ্গলে ঢকার মুখে আছে রেজিস্ট্রেশন বুথ সেখান থেকে নাম রেজিস্ট্রেশন করে জঙ্গলে ঢুকতে হয়। জঙ্গলের কোন ক্ষতি না করে, গাছের মধ্যে দিয়ে চিকন করে পায়ে হাঁটার পথ করা। কাঠ দিয়ে তৈরি এই রাস্তা টা দেখতে এতো সুন্দর যে মনে হয় যেন জঙ্গলের ই অংশ এটা। দুই পাশে গাছের সারি, ঘন ঝোপ আর গাছের গায়ে গাছের নাম এবং বিবরন লিখা সাইনবোর্ড লাগানো আছে। ওগুলো সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া সম্ভব না তাহলে এই জঙ্গলে মাস খানেক ধরে হাঁটতে হবে। যে গাছগুলো একটু বেশি আকর্ষণ করলো আমাকে সেগুলো সম্পর্কে খানিকটা জেনে নিচ্ছি।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই চোখে পড়ে একেকটা অদ্ভুত শেপের গাছ। কোনটা টুইস্ট পাস্তার মতন পেঁচানো, কোন গাছের শিকড় শুরু হয়েছে গাছের শরীরের অর্ধেক অংশ থেকে।
আবার কোন গাছের শিকড় এতো বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত যে আপনার দেখলেই মনে হবে কোন দানব আকৃতির কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
নিচের লিঙ্কে গিয়ে এই গাছটির এবং তামান নেগারার রেইনফরেস্টে আমার পুরো জার্নির ভিডিও টি দেখতে পারেন। আশা করি ভালো লাগবে।
এই জঙ্গলে ২০০ র বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাঘ, হাতি, রাইনো, জলহস্তী, চিতা, সূর্য ভাল্লুক সহ আরো অনেক ধরনের প্রাণী।
ওহ, এখানে কিন্তু সাপ ও আছে ১০০ প্রজাতির বেশী। কিন্তু ভয়ের কোন কারন নেই। কারন যতটুকু মানুষকে যেতে দেয় জঙ্গলের ভেতরে ততটুকুর ভেতরে এমন কিছু নেই যা দেখে আপনি ভয় পেতে পারেন। জঙ্গলের ২-২.৫ কিমি পর্যন্ত যাওয়া যায়। তার পরে টুরিস্টদের জন্য যাওয়ার আর অনুমতি নেই। রিসার্চ কিংবা এধরনের বিশেষ কোন কাজে অনুমতি সাপেক্ষে জঙ্গলের আরও ভেতরে যাওয়া যায়।
হাঁটার পথের পাশে তাই নানান ধরনের, অদ্ভুত আকৃতির গাছ দেখতে দেখতে এগুতে থাকলাম আমি। এই রেইনফরেস্টের প্রতি হেক্টরে কমপক্ষে ২৮০টি গাছের প্রজাতি রয়েছে। এই রেইনফরেস্টে সবচেয়ে বেশি পরিমানে আছে তুয়ালাং ট্রি যেটি সোজা লম্বা হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। পুরো গায়ে কোন ডাল, শাখা কিচ্ছু থাকেনা। শুধু ওপরের দিকে মাথায় এক গুচ্ছ পাতার ঝোপ থাকে। অদ্ভুত আকৃতির এক গাছ যেটা আপনি গিয়ে দেখলেই চিনতে পারবেন।
আমি এখন চলে আসছি পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা কেনোপি ওয়াকওয়ে র কাছে। নিচে একটা বুথ মত আছে যেখানে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। নিরাপত্তার খাতিরে একসাথে অনেক লোককে যেতে দেয়া হয়না। কিছু লোক যায় তারা নেমে যাওয়ার পরে আবার আরেক ব্যাচ পাঠানো হয়। তো আমি এখন অপেক্ষা করছি ১০ টা ব্রিজ সেকশন দিয়ে তৈরি ৫০০ মিটার উঁচু কেনোপি ওয়াকওয়ে তে যাওয়ার জন্য।
ঝুলন্ত এই ব্রিজে হেঁটে যেতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় যেটা আসলে বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না। আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে। আর ব্রিজের ওপর থেকে নিচের ঘন জঙ্গল দেখতেও অসাধারন লাগে।
নেমে এলাম কেনোপি ওয়াক শেষে। এবার আবার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফেরার পালা। নদীর কাছাকাছি আসতেই সকালে দেখে যাওয়া সেই রিসোর্ট এরিয়ার অন্য প্রান্তে ঢুকে পরলাম। এপাশে ওদের ইকো কটেজ গুলো দেখতে পাচ্ছি। মাঝে পায়ে হাঁটার রাস্তা আর দুই পাশে ছোট ছোট আলাদা আলাদা কটেজ। বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে এই রিসোর্ট টি। নদীর এপারে রেইনফরেস্টের মধ্যে থাকার এটি ই একমাত্র রিসোর্ট। স্বাভাবিকভাবেই এর সৌন্দর্য এবং লাক্সারির কারনে বেশ ব্যয়বহুল এটি। তবে ঘন জঙ্গলের ভেতরে নদী ঘেঁষা এতো সুন্দর একটা রিসোর্টে থাকার অভিজ্ঞতা টা কিন্তু অসাধারন হবে।
আমি হেঁটে নদীর কাছে আসতেই কোন রকম পূর্বাভাস ছাড়াই ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে ও ঘাট পর্যন্ত যেতে পারলাম না। মুষল ধরে বৃষ্টি শুরু হল। মাঝখানেই একটা ছাউনি মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুহূর্তেই পাল্টে গেল চারপাশের দৃশ্য। জংগল, নদী আর নদী ঘেঁষা ছোট্ট কুয়ালা তাহান গ্রামের সৌন্দর্য অনেকটা বেড়ে গেছে যেন বৃষ্টির ছোঁয়ায়। নদীর ওই পাড়ের গ্রামটাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছিল। আমি বসে পরলাম প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দরয দেখেতে, বসে থাকলাম বৃষ্টি থেমে যাবার পরেও অনেক্ষন। ঘণ্টা খানেক পরে সম্বিত ফিরে পেলাম পেটের ক্ষুধা অনুভব করাতে।
প্রায় বিকেল হতে চলল। এবার আমার ওপারে যেতে হবে। পেট খালি হলে সব সৌন্দর্য ফিকে হয়ে যায়। আমার দুপুরের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি। তাই বোট এলে আমি উঠে বসলাম। শেষ হল আমার তামান নেগারা জঙ্গল যাত্রা। ফিরে যাচ্ছি খুব সুন্দর কিছু অনুভূতি নিয়ে।