শুধুমাত্র প্রকৃতি প্রেমীদের জন্যই না বরং সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাওয়া সবার জন্যই সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন অবশ্যই ঘুরে দেখার মতন একটি জায়গা। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সবুজ দৃশ্য, ঠাণ্ডা আবহাওয়া, অসাধারন শৈল্পিক উপায়ে বাগান সাজানোর ধরন এই সমস্ত কিছু একজন দর্শনার্থীকে সারা জীবন মনে রাখার মতন অভিজ্ঞতা দিবে। আমি যত হাঁটছিলাম প্রতি পায়ে পায়ে ই মুগ্ধ হচ্ছিলাম কখনো রঙিন সব অর্কিড দেখে, কখনো সাধারন চলার পথটাকেই ঝুলন্ত গাছ দিয়ে অসাধারন উপায়ে সাজানোর ধরন দেখে।
সারাদিন হেঁটেও আমি ক্লান্ত তো হই ই নি বরং নানা রকমের পাখির ডাক আমার মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি দিচ্ছিল। সবুজ, রঙ-বেরঙের ফুল, গাছ, লতা-পাতা এগুলো যে কারো চোখ, মন দুটোর জন্যই প্রশান্তিদায়ক।
অর্চারড রোদ থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দুরত্তে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেন টাংলিন রোড থেকে বুকিট থিমা রোড পর্যন্ত বিস্তৃত।
ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্তের দিক বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনকে UNESCO World Heritage site হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৫৮ বছরের ও বেশী পুরাতন এই গার্ডেনটি মূলত ৩টি অংশে বিভক্ত- টাংলিন অংশ, কেন্দ্রীয় অংশ এবং বুকিত তিমাহ অংশ। ৭৪ হেক্টরের ও বেশী জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই গার্ডেনে ছোট-বড় সবার জন্যই নানা ধরনের আয়োজন করা আছে।
প্রতি মাসের প্রথম থেকে চতুর্থ শনিবারে ফ্রি ট্যুর গাইড থাকে যে দর্শনার্থীদের এই গার্ডেন ঘুরে দেখায় এবং বিভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকে। ছুটির দিনে সিম্ফনি স্টেজে বিভিন্ন ধরনের কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।
সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন বছরের প্রতিদিন ই সকাল ৫ টায় খোলা হয় এবং বন্ধ হয় রাত ১২ টায়। এখানে প্রবেশের জন্য কোন টিকেট লাগেনা। শুধু ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেনে প্রবেশের জন্য ৫ ডলার দিয়ে টিকেট কাটতে হয় তবে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড দেখালে অর্থাৎ আপনি স্টুডেন্ট হলে বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারেন। যেহেতু বিশাল বড় একটি জায়গা এটি তাই আপনি আগে থেকে না জানলে অনেক কিছু দেখাই মিস হয়ে যেতে পারে। সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিশেষ যে জায়গাগুলো আছে অবশ্যই দেখার মতন-
ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেনকে বলা যায় সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রধান আকর্ষণ। এই অর্কিড গার্ডেনে ১০০০ ধরনের এবং ২০০০ হাইব্রিড প্রজাতির অর্কিড আছে।
অর্কিড গার্ডেনের ভেতরেই আবার আছে-
১। বারকিল হল,
২। ভিআইপি অর্কিড গার্ডেন,
৩। অর্কিডারিয়াম,
৪। Tan Hoon Siang Misthouse,
৫। Lady Yuen-Peng McNeice Bromeliad House এবং
৬। Coolhouse
সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মূল অংশে অবস্থিত সিম্ফনি লেকটি তৈরি করা হয়েছে কৃত্তিম উপায়ে। লেকের মাঝখানে একটি ষ্টেজ তৈরি করা হয়েছে যেখানে বিভিন্ন ধরনেরর কনসার্ট, অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
সোআন লেক ও কৃত্তিম উপায়ে তৈরি করা একটি লেক যেটি Tyersall Avenue তে অবস্থিত। এই লেকে থাকা প্রচুর হাঁসের জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে সোআন লেক।
ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেনের পাশেই অবস্থিত জিনজার গার্ডেন। ১ হেক্টর জমির ওপর তৈরি করা এই গার্ডেনে আছে কৃত্তিম পানির ঝর্না, জলপদ্ম লেক সহ আরও অনেক দৃষ্টিনন্দন সব জিনিস।
বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা এই গার্ডেনের নামকরন করা হয়েছে এর প্রধান দাতা Jacob Ballas এর নামানুসারে। এখানে বিভিন্ন ধরনের খেলার জায়গা যেমন- Water Play area, ছোট্ট খেলার মাঠ, ট্রি হাউস, ধাঁধাঁ সহ নানান জিনিস আছে বাচ্চাদের আকর্ষণ করার। আপনি চাইলে শুধু মাত্র আপনার বাচ্চাদের এই জায়গাটুকু ও ঘুরে দেখাতে পারেন। কারন বুকিত তিমাহ রোডের দিকে এই অংশে প্রবেশ করার আলাদা গেট আছে।
এই বাগানের মূল উদ্দেশ্য হল দর্শনার্থীদেরকে এটা বোঝানো যে গাছ শুধুমাত্র সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই প্রয়োজন না বরং সমস্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যও গাছ অপরিহার্য। এই বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হবে সময়ের সাথে জার্নি করে চলেছেন আপনি। সেই প্রাচীনকাল থেকে যখন পৃথিবী ছিল আগুনের মতন তখন থেকে এখন পর্যন্ত যখন পৃথিবীতে আছে ২,৫০,০০০ প্রজাতির নানা রকমের গাছ দিয়ে সবুজ আর রঙিন হয়েছে এই পৃথিবী।
ইকো গার্ডেন হল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ যেমন- বাঁশগাছ, ফুলের গাছ, ফলের গাছ, মশলার গাছ ইত্যাদির এক অনন্য সমাহার যেগুলো মানব সভ্যতায় অর্থনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ইকো লেক হল প্রশান্তির একটি জায়গা যেখানে আছে শান্ত পানির জলাধার, অস্ট্রেলিয়ান কালো হাঁস, জলজ গাছ ইত্যাদি।
এছাড়াও আরও অনেক জায়গা আছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেগুলো কোন না কোনভাবে বিশেষায়িত করা এবং দর্শকদের জন্য মনোরমভাবে উপস্থাপন করা-
# Saraca স্ট্রিম
# Bandstand
# Sundial গার্ডেন
# Hanging Roots প্যাসেজ
# Swiss Granite Ball
# পাম ভ্যালী
# Fruit Tree Collection
সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন হল এমন একটি জায়গা যেখানে মানুষের তৈরি শিল্পকর্ম এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুটো একসাথে মিলেমিশে দর্শনার্থীদেরকে অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা দেয়। আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমী না ও হোন তবু সুন্দরভাবে পরিকল্পিত, সুসংগঠিত এবং সুসজ্জিত এই জায়গাটি আপনার মন আর চোখকে অসাধারন এক প্রশান্তি দিবে। তাই সিঙ্গাপুর গেলে এই সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন না দেখলে সিঙ্গাপুরবাসীদের প্রকৃতি প্রেম, শৈল্পিকবোধ সম্পর্কে অনেক বড় একটা অংশ অদেখা থেকে যাবে।